ডেভিড কপারফিল্ড সম্পূর্ণ গল্প

আমার বাবাকে আমি কখনো দেখিনি। আমার জন্মের ছয় মাস আগে আমার বাবার কেউ থেকে এইপৃথিবীর আলো চিরকালের জন্য মুছে গিয়েছিল, তিনি আমাকে দেখেননি ।

আমিই থাকতাম আমার মায়ের সঙ্গে। মা হালকা গড়নের মহিলা, আমার এক দাবি তাকে বলতেন মোমের পুতুল।

মার  স্বভাবটিও কোমল প্রকৃতির তিনি কখনো রাগ করতে পারতেন না। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো পেগুটিও থাকতো আমাদের বলে একটি মেয়ে ওর সঙ্গে মাকে কোনদিন উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি।

পেগুটি থাকতো আমাদের পরিবারের একজন হয়ে, আমাদের খেলাধুলা সব একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে একই টেবিলে। পড়াশোনা আমি করতাম মায়ের কাছেই।

মায়ের কাছে লেখাপড়া ব্যাপারটা খেলাধুলা মতই ভালো লাগতো। মা আর  পেগুটি সঙ্গে আমার বেশ ভালই  কাঁদছিল।আমার এই  ছিমছাম সুখের জীবন প্রথম ধাক্কা আসে আমার আট বছর বয়সে।

মা একদিন ফের বিয়ে করলেন। আমার সৎ বাবা  মার্ডস্টন সাহেব  দশাসই পুরুষ, তার  মস্ত জুলফি পুরু   গোফ জোড়া ভ্রু। তাকে দেখে প্রথম থেকে আমার ঠিক নিজের লোক বলে মনে হয়নি।

এর ওপর আমাদের সঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে এলেন তার  বোন। ভাই বোনের চেহারায় খুব মিল গলার স্বর প্রায় একই রকম। ভাই বোনের  স্বভাবও একইরকম। যেমন মার্ডস্টন সাহেব তেমনি তার বোন দু’জনই কড়া মেজাজের মানুষ।

ছোট ছেলে ছেলে মেয়েদের দুধ তারা দাস বরদাশ্ত করতে পারতেন না, আসার পর থেকে আমার কথা বাত্রা  আদব কায়দায় খুতবার করার জন্য একেবারে যেন হয়ে উঠেছেন।

 এমন আমার  লেখাপড়া শেখাবার কাজটিও মার্ডস্টন  সাহেব নিজে উৎসাহ উৎসাহিত উঠলে। আমি কিন্তু কোনো ব্যাপারই তার কাছে যেতে চাইতাম না। পড়াশোনা করে পড়া দিতে মাকেই।

কোথাও মা বাবা ডেভি মনে ফোনটা করতে পারছো না? একটু চেষ্টা করে  দেখতো। মার্ডস্টন সাহেব কর্কশ গলায় বলতে আহ। ক্লারা এভাবে বললে হবে না।মার্ডস্টন সাহেবের বোন ও এক পরী রকম কন্ঠে ভাই এর সমর্থনে

এগিয়ে আসতেন সোজা বলে দাও পড়া মুখস্ত করে  আসুক।এখান  তাদের বলা মুখে কিছু আমার মায়ের সাধ্য কুলায় না। আমি আবার বই নিয়ে বসি।

কিন্তু মুশকিল হল এই যে মায়ের কোন কোল ঘেঁষে পানি মত করে বুঝতে পারি, যে ও পড়া অবলীলায় বলে  যাই, মার্ডস্টন সাহেব কি থাকলে হয়ে ওঠে না।

মার্ডস্টন সাহেব জিজ্ঞেস জিজ্ঞেস করলে আমার মুখস্ত যায় পড়া ভুলে যাই।ঠিকমত পড়া দিতে পারলেও তাদের মন পাওয়া যায় না, মার্ডস্টন সাহেব এমন সব কঠিন অংক করতে দিতেন যে আমার একেবারে তাহির তাহির অবস্থা হতো।

তাদের এড়িয়ে চলার জন্য আমি গিয়ে ঢুকলাম আমার ঘরের লাগোয়া ছোট ঘরে। এখান আমার বাবার কয়েকটি  বই  স্তুপ করে রাখা ছিল। তার মৃত্যুর পর থেকে এসব কেউ ছুইওনা দেখতো না।

এখানে একা একা বসে আমি রডারিক র‍্যানডম টপ জোনস  ভিকার অফ রয়েলফিল  ডন কুইক সোট, রবিনসন ক্রুসো আরব্য রজনী-এসব বইপত্র পড়তাম।

কিন্তু মার্ডস্টন সাহেবের হাত থেকে তবু আমার রেহাই নেই। আর আমার এমন অবস্থা যে তার হাতে পড়লেই পড়া আর বলতে পারি না।

একদিন এমন কি ভুল হয়ে গেল,মার্ডস্টন সাহেব আমার ঘরে ঢুকলেন হাতে বেদ নাচাতে নাচাতে পেছনে তার বোন। প্রায়  ফোজি কায়দায় দুজনকে ঢুকতে দেখে মা ভয়ে কাঁপছিলেন।

আমার উপর হঠাৎ করে বেতের বারি পড়তে শুরু করলে আমি চিৎকার করে বললাম মারে পুরি মারে মারবেন না, মারবেন না।  আমি তো আজ সারাদিন ধরে পড়লাম।

আপনাদের দুজনকে দেখে সব ভুলে গিয়েছি, আপনার দেখলে গুলিয়ে ফেলি।তাই?  বাজখাই গলায় মার্ডস্টন সাহেব বললেন,সব গুলিয়ে ফেলো না?

দেখি কি করে মনে রাখতে পারো সেই ব্যবস্থা করি। আমার মাথাটা তিনি আঁকড়ে ধরতে চাইলে চাইছিলেন, কিন্তু আমি মাথা গলিয়ে তার হাত থেকে মুক্ত হলে তিনি আমার মুখ চেপে ধরে পিঠে সপাং সপাং করে বেতের কয়েকটা গা মারলেন।

আমি আর সহ্য করতে না পেরে আমার মুখে চেপে ধরা হাতের বুড়ো আঙ্গুলে  এ্যায়সা জোরে এক কামড় বসিয়ে দিলাম যে যন্ত্রণায় তিনি একেবারে চিৎকার করে উঠলেন।

তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে তিনি শুরু করলেন তার আসল  মার, বেতের হুম ঘুম আঘাতে আমার শরীর একেবারে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। ভাবলাম আজ আমি একেবারে মরেই যাব।

মারতে মারতে মার্ডস্টন সাহেব ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আমার ঘরে আমাকে  ঠেলেবাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হল। অন্ধকার ঘর হয়ে এলো, কিন্তু ঘরে আমার একটি বাতি ও জলল্ব  না। এরমধ্যে মিস মার্ডস্টন  রুটি আর কয়েক টুকরো গোশত দিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু অন্ধকার হওয়ার আর কেউ এলোনা। আমি একা একাই ঘুমিয়ে পড়লাম। এইভাবে পাঁচ দিন কাটলো, আমার মনে হলো মার্ডস্টন সাহে বের হাত কামড়ে দিয়ে আমি বোধহয় ভয়ানক একটি অপরাধ করে ফেলেছি।

আমার মা একদিনো এলেন না, তাকে পেলেও না হয় আমি মাফ চাইতে পারতাম। পেগোটি আমাকে চুপ চুপ করে খবর দিয়ে যায় যে।

লন্ডনের একটি আবাসিক ইস্কুলে আমাকে ভর্তি করার আয়োজন চলছে। দেখতে দেখতে আমার বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এল।

আমি বিদায় নেওয়ার সময় মার গলা বেশ ভারী হয়ে  আসছিল। এতে মার্ডস্টন সাহেব মধ্যে তার বোন দু’জনই খুব বিরক্ত। আমার জন্য মাঝে একটু প্রাণ খুলে কাঁদবেন এরা সে অধিকারটুকু ও তাকে দিতে রাজি নন।

ঘোড়ার গাড়ি যাত্রা শুরু করলো। পকেট থেকে বের করে আমি চোখে  চেপে ধরলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি তা ভিজে একেবারে চপচপ হয়ে গেছে। আজমাইল পথ পেরিয়ে গাড়িটা একটু থামে।

থামতে না থামতে পথের ধারে যুগ থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে পেগোটি। এক লাফে গাড়িতে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বাড়িতে আমাকে আদর করা দূরে থাক, বেচারী কথা বলার সুযোগটা পর্যন্ত পায়না।

আমাকে ছেড়ে দিয়ে একটি কাগজের টুকরো আমার হাতে তুলে দিয়ে আর একবার সে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তার থেকে জরুরী একটি ব্যাগ রেখে দিল।

চলতে শুরু করলে আমি ব্যাগটা খুলে দেখি একটা টুকরো কাগজে আমার মাল লেখা  ডেবিট ডেভিক অনেআদর ও ভালোবাসা। কাগজের সঙ্গে কয়েকটি টাকা।

কিছুক্ষণ পর একই এক্কাগাড়ি থেকে নেমে উঠতে হলো লন্ডনগামী কোচে। বিকাল তিনটের ঘোড়ায় টানা সেই  ছাড়লো।  লন্ডন কথা সকাল আটটায়।  কোচে রাত্রিটা কিন্তু তেমন আরামে কাটেনি।

দুই পাশে দুইজন ভদ্রলোক ঘুমোতে শুরু করলেন আমার দুই ধার হলো তাদের দুজনের বালিশ। আমার অবস্থা একেবারে  শোচনীয়।

শেষ পর্যন্ত সূর্য উঠলো। আমার দুই দিকের দুই সহযোগীর ঘুম ভাঙলো। কিছুক্ষণ পর  লন্ডন আমার যে  শিহরণ হল তা আমি  বুঝিয়ে বলতে পারবোনা । এই আমার স্বপ্নের লন্ডন শহর।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় এখানে আমি একেবারে  একা। রবিনসন ক্রুসোর চাইতেও একা। রবিনসন ক্রুসো যে একা তা তো আর কেউ দেখেনি আর এই  জনাকীর্ণ শহরে আমার একাকীত্ব যেন সকলের চোখে পড়ছে।

নানা রকম ঝামেলার পর এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার দেখা হলো। তিনি আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলেন তুমিতো নতুন এলে? আমার দিকে তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন এসো আমি সালেম হাউসের শিক্ষক।

আমি জানি যে সালেম হাউজের আমাকে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু ওই স্কুলে এই শিক্ষককে চেহারা একটু আকর্ষণীয় নয়। দেখতে তিনি বড় রোগা গায়ের রঙ ফ্যাকাশে তার পোশাক ও বিবর্ণ প্যান্ট শার্টের হাতা বেশ খাটো।

আমার হাত ধরে তিনি চলতে শুরু  করলেন। এদিকে শরীর  বেজায় ক্লান্ত। বাধ্য বাধ্য  ঠেকছিল তবে আমার নতুন শিক্ষকের চেহারা দেখে ভয় পাবার কিছু নেই। আমি বললাম কাল দুপুরের পর থেকে কিছুই  খাইনি।

আরো সাহস করে বললাম কিছু কিনে  খেলেভালো হতো। তিনি রাজি হলে একটা দোকান থেকে ডিম আর মাংস কিনে  নিলাম। এখন এগুলো খাবো কি করে? আমার নতুন শিক্ষক একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে কোথায় যে নিয়ে চললেন আমি ঠিক বুঝতে ও পারছিলাম না।

রাস্তায় সাংঘাতিক কোলাহল হুইচই এইসব আওয়াজে আমার মাথায় জট পাকিয়ে যাচ্ছিল। লন্ডন ব্রিজ বেরোবার সময় ঘুমে আমার চোখ জুড়িয়ে আসছিল। কিছু চলার শিক্ষক  আমাকে নিয়ে  নামলেন।

তার সঙ্গে আমি যে ছোট ঘরটিতে ঢুকলাম সেটি দেশ গরীব কোন মানুষের বাসস্থান দেখেই বোঝা যায় এটা কোনো অনাথ আশ্রম এর অংশ। আবার পাথর রয়েছে, ২৫ জন দরিদ্র রমণীর জন্য প্রতিষ্ঠিত।

ছোট  সেতসেতে ঘরটিতে  ডুকতেই এক মহিলা খুশিতে ডেকে উঠলেন, বাবা চার্লি। কিন্তু আমার দিকে তাকে পড়তে একটু থমথম খেয়ে চুপ করলেন।

নতুন শিক্ষক  তাহাতে ডিম দিলে  সসপ্যানে সেটা ভেজে দিলেন মাংসের টুকরো সেদ্ধ করে  দিলেন। আমি তো তখন ক্ষুধার্থ প্রবাসে ওইসব খাচ্ছি তো শুনি যে বৃদ্ধ মহিলা শিক্ষককে বললেন, বাশিটা সঙ্গে থাকলে একটু রাগ বাজাও না।

হাত দিয়ে শিক্ষক বাসির তিনটে টুকরো বের করলেন টুকরোগুলি জোড়া দিয়ে সম্পূর্ণ বাঁশি ঠিক করে নিয়ে তিনি  বাজাতে শুরু করলেন।

ত্রিশূর বাজালেন আমি জানিনা কেমন বাজিয়েছেন তাও বুঝি নি কিন্তু তার পাশে তীব্র ধনী আমার বুকে দারুণ প্রতিধ্বনি তুলল আমার সমস্ত বেদনার কথা যেন খুড়ে উপরে উঠে এল আমার সব কষ্টের কথা মনে পরল শেষ পর্যন্ত চোখের পানি আজ চেপে রাখতে পারলাম না।

এরম বই মুভি শিখো চেহারার  মিল রেখে আমি বুঝতে পারছিলাম যে এরা মা এবং ছেলে। আমার শিক্ষকের মা এতো গরিব কেন দাতব্য ভবনে বাস করেন কেন এসব প্রশ্ন মনে একটু উঁকি দিল আমার সমস্ত মাথা জুড়ে তখন কেবল বাশির সুর।

আমার আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। যখন ঘুম ভাঙলো দেখি আমি ঘোড়ার গাড়িতে বসে রয়েছি। পাশে পায়ের ওপর আড়াআড়িভাবে আরেকটি পারে কে বাঁশি বাজিয়ে চলেছে আমার নতুন শিক্ষক। আমি ফেল ঘুমিয়ে পড়ি।

গাড়ি থামলে স্যার আমাকে নিয়ে নিচে নামলেন। সামনে উঁচু দেয়ালে এসমস্ত একটি বাড়ি বড় করে সালেম হাউস।এটাই তাহলে আমার নতুন স্কুল। দরজার কড়া নাড়তে শক্ত-সমর্থ একটি লোক বেরিয়ে আসে।

ঘারটা ঘাড়ের ঘাড়ের  মতো মোটা,একটা পা কাঠের ছোট করে কাটা মাথার চুল। আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে সে আমাকে ভাল করে দেখল।

লোকটি ভেতর থেকে একজোড়া দুটো এনে সামনে ফেলে দিতে দিতে বলল। মেল সাহেব মুচি আপনার দুটো ঠিক করতে চায় না। এটা মেরামত করার কিছু নেই, তালি দিতে দিতে একেবারে শেষ হয়ে গেছে।

জুতোজোড়া হাতে আমার নতুন শিক্ষক মেম সাহেব উপরে উঠতে লাগলেন, পিছে পিছে আমি। ডলার ওঠে শেষ প্রান্তে ঘরে  হাঁটছি, হঠাৎ চোখ পরল একটি বোর্ডের  বিকে, বোর্ডের সুন্দর করে লেখা সাবধান একটা কামড়ায়। আশেপাশে নিশ্চয় কোন কুকুর আছে।

এবং সেটা অবশ্যই কামরায় এই ভেবে আমি থমকে দাঁড়ালাম। মেম সাহেব পেছনে তাকিয়ে বললেন কি হলো? এখানে বোধ হয় কুকুর আছে স্যার।

বোর্ডের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন কুকুর নয় কপারফিল্ড। আমাকে বলা হয়েছে এই ভুট্টা যেন তোমার পিঠে সঙ্গে আটকে দিই। এখানে এসে প্রথমে তোমার মনটা খারাপ করে দিতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এটা আমাকে করতেই  হবে।

আমার সব বাবার হাতে আঙ্গুলে কামড় দিয়েছিলাম, সেই খবর তাহলে এখানেও পৌঁছে দেওয়া  হয়েছে, তার শাস্তি কি আমাকে পেতে হবে এভাবে? সত্যিই আমি একেবারে  দমে গেলাম।

ক্লাসের সহপাঠীরা আমার পিঠ দেখবে আর আমাকে নিয়ে যেয়ে কি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করবে ভাবতেই লজ্জায় ভয়ে আমি  এক  একবোরে  কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। স্কুলে মালিক এবং প্রধান   ক্রিকল সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন।

তার সুন্দর বৈঠকখানায় বসেছিলেন মিসেস  ক্রিকল আর তাদের মেয়ে। এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম কাঠের পা ওয়ালা ওই  লোকটিকে।

ক্রিকল সাহেবের মুখ টকটকে লাল, মনে হয় সব সময় সেখানে আগুন জ্বলছে চোখ জোড়া তার ছোট কপালের মুক্তগুলো সব স্পষ্ট দেখা যায়।

তিনি জি জ্ঞেস করলেন এর নামে কোন রিপোর্ট আছে?  ক্রিকল  স্যার কাঠের পা ওয়ালা জবাব দিল নতুন এসেছে এখন পর্যন্ত তেমন কিছুই করার সুযোগ পায়নি এদিকে এসো।

ক্রিকল  সাহেব আমাকে এই আদেশ দিলে কাঠের পা ওয়ালা বলে ওঠে এদিকে এসো।  আমি তার দিকে এগিয়ে এলে আমার কান ধরে ক্রিকল  সাহেব বললেন, তোমার সব বাবাকে আমি চিনি শক্ত স্বভাবের মানুষ।

তা তিনিও আমাকে ভালো করে চেনেন। তুমি আমাকে চেন? না স্যার। চেন না না? আমার কানে একটা মোচড় দিয়ে তিনি বললেন চিনবে। ক্রিকল  সাহেবের এই ব্যবহারে আমার যতই খারাপ লাগুক অনেক বেশি ভয় করতে লাগল।

স্কুল খুললে ছেলেদের আচরণটা কি হবে সেই ভাবনা করে। তো এক দিন স্কুল খুললো ছেলের ছেলেরা হোস্টেলে এসে পড়ল।

ছেলেরা যথারীতি আমার পেছনে লাগলো, কারো পিঠে অমনি একটা বোর্ড সাতটা থাকলে কিছু  ঝক্কি  তো তাকে পোয়াতে হবই। তবে যা ভেবেছিলাম সে রকম ভয়াবহ গোছের কিছু ঘটনা না।

সাবধান এটা কামড়ায় বলতে বলতে  ছেলেরা আমাকে  খ্যা পাতকেউ কেউ আঁতকে ওঠা ভান করত।

আবার বুড়ো মানুষের মতো নাচতে নাচতে কুকুর কুকুর বলে চিৎকার করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ ছেলেই তেমন উৎপাত করেনি।

এর ওপর ক্রিকল সাহেব ক্লাসে একদিন আমাকে বেদম মারতে গিয়ে দেখলেন যে পিঠে সাদা ওই বোর্ডের জন্য বেতের বারি ঠিক জুতো মত লাগানো যাচ্ছে না।

তাই তিনি নিজেই ওটা খুলে ফেললেন।তবে ছেলেদের উৎপাত এর হাত থেকে বাঁচতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন আমাদের ক্লাসের একটি ছেলে।

ওর নাম জে  স্টিরহোর্ড আমার চেয়ে অনেক বছর পর এই ছেলেটি দেখতে বেশ সুন্দর ছাত্র হিসেবে মেধাবী বলে তার বেশ নামডাক রয়েছে।  তার প্রতি ক্রিকল সাহেব একটু পক্ষপাতিত্ব লক্ষ করা যায়।

তো এই ছেলেটি প্রথম থেকেই আমার সঙ্গে বেশ ভালো করে ফেলে। রবিনসন ক্রুসো আরব্য রজনী ডন কুইক্সোট এসব বইয়ের গল্প আমি বেশ জমিয়ে বলতে পারতাম বলেছেন এটা অনেকেই আমার পাশে  ভির করতো।

স্ট্রেটফর্ড আর আমি রাতে পাশাপাশি বিছানায় ঘুমাতাম, ঘুমাবার আগে তাকে রোজ ওই সব গল্প বলে শোনাতে হতো। এমনিতে টিরফোর্ট আমাকে ঘাটাতে সাহস পেত না।

কিন্তু টিরফোর্ট  কখনো কখনো বড্ড নিষ্ঠুর হয়ে উঠত।একদিন বিকেলবেলার কথা আমার খুব মনে পড়ে। মেল সাহেবের ক্লাসে গোলমাল হচ্ছিল। মেল সাহেব এমনিতে নিরীহ গোছের মানুষ সহজে বড় গলা করে কথা বলতে পারতেন না।

সেদিন আমি তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়া  দিচ্ছিলাম, ছেলেরা  নিজেদের মধ্যে কথা বলেই চলেছ্‌ ক্লাসে যে একজন শিক্ষক আছেন তা বোঝাই যাচ্ছিল না। মেল সাহেবের  সহ্য বাঁধ ভেঙে গেল।

তিনি হঠাৎ করে চিৎকার করে ধমক দিলেন চুকচুক কর। তার মুখে এরকম ধমক শুনতে অভ্যস্ত ছেলেরা অবাক হয়ে চুপ করে  গেল। শেষ শাড়িতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে শিস দিচ্ছিলটিরফোর্ট  সে কিন্তু থামল না।

শিস দিয়েই চলল। মেম সাহেব বললেন টিরফোর্ট  চুপ কর। আপনিই চুপ করুন। স্টিরফোড পাল্টা ধমকে  সুরে বলল জানেন আপনি চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলছেন কার সঙ্গে?

স্টিরফোড তুমি কি ভেবেছো তোমার বেয়াদবি আমি লক্ষ্য করিনি? ছোট ছোট ছেলেদের তুমি বারবার  উসকে দিচ্ছে আমি কি  দেখছি না ভেবেছ?

বলতে মেইল সাহেবের ছোট জোড়া কাঁপছিল সবাই জানে যে এখানে তোমার দিকে পক্ষপাতিত্ব করা হয় সেই সুযোগ নিয়ে তুমি একজন ভদ্রলোক কে এভাবে অপমান করতে সাহস পাও?

ভদ্রলোক? স্টিরফোড বিস্তৃত হবার ভান করে বলল ভদ্রলোকটি কোথায় বলুন তো?স্টিরফোড এক জন্য হতভাগ্য মানুষকে এভাবে অপমান করে তুমি খুব ইতর ব্যবহার করলে। কপার ফিল্ড পড়া বলে যাও।

স্টিরফোড বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল সুমন একজন বিক্রির মুখে এরকম কথা মানায় না। হঠাৎ ঘরের ভেতর ক্রকলসাহেবের ফ্যাসফেসে গলায় আওয়াজ গর্জে উঠলো।

মেম সাহেব কি হচ্ছে? মেম সাহেব চমকে উঠলেন।স্টিরফোড বলল স্যার আমার প্রতি নাকি এখানে পক্ষপাতিত্ব করা হয় মেইল সাহেব এই কথায় আমি প্রতিবাদ করছি লাম।

পক্ষপাতিত্ব হেসে গলায় যতটা সম্ভব  হ্লস্কার  ক্রিকল কল সাহেব বললেন। ভিকারি মেম সাহেব বিক্রি করেন কোথায়?

তিনি বৃক্ষে না করলে আত্মীয় করে একই হলো। বলতে বলতে স্টিরফোড  আমার দিকে তাকায়। মেম সাহেব তখন আমার ঘাড়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে চাপ  দিচ্ছেন।

লজ্জা  অনুতাপে আফসোসের আমি মাথা নিচু করে থাকি, আমি একদিন কথা মেয়ে করেছিলাম তিনি যে  দাতব্য আলোয় বাস করেন সে কথা তো বলা হয়ে গিয়েছিল। আমার চোখ নিচের দিকে মেম সাহেব কিন্তু আমার ঘাড়ে আদর করে আস্তে আস্তে চাপ দিয়ে বলেছেন।

এর মধ্যে স্টিরফোড বলেই ফেলল মেয়ের সাহেবের দাতব্য আলো হয়ে অন্য হয় রাতের উপর বেঁচে থাকেন।

মেম সাহেব তখন সুন্দর বালকটির মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কষ্টে ক্রিকল সাহেবের  উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন আমার এই প্রতিষ্ঠানে তো এরকম লোক কে এমন করতে দেওয়া যায় না।

কি কল সাহেবের কপালের চপ করে ফুলে উঠল তিনি বললেন আপনি কি এটা একটা দাতব্য স্কুল ভেবেছেন? আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন এখন এখান থেকে অব্যাহতি  নিয়ে চলে গিয়ে আমাদের অপমান থেকে অব্যাহতি দিন।

তার সমস্ত  সম্বল যা ছিল কয়েকটি বই এবং তার বাহিনী এমএল সাহেব আমাদের স্কুল থেকে চলে গেলেন। ওই রাত্রেও স্টিরফোডকেগল্প শোনাতে শোনাতে আমি মেম সাহেবের বাশির সুর শুনতে যাচ্ছিলাম।

রাত অনেক হলে স্টিরফোড ঘুমিয়ে  পড়ল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি যেন শুনতে পাচ্ছিলাম যে এখান থেকে অনেক দূরে অন্য কোথাও বসে মেয়ের সাহেব যেন বিষাদআচ্ছন্ন এক নাগাড়ে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন। আমি খুব অসহায় বোধ  করছিলাম। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *