সাহিত্যের রূপ ও রীতি-সম্পর্কে জানুন অজানা তথ্য

কবিতা

চন্দোবদ্ধ ভাষায় অর্থাৎ গদ্যে যা লিখিত হয় তাকেই আমরা ,কবিতা, বলে থাকি । কবিতার প্রধান দুটি রুপভেদ হলো- মহাকাব্য ও গীতিকবিতা । বাংলা ভাষায় মহাকাব্যের চূড়ান্ত সফল রূপ প্রকাশ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর  মেঘনাদ- বধ কাব্যে । মহাকাব্য রচিত হয় যুদ্ধ বিগ্রহের কোনো কাহিনী অবলম্বন করে ।

ভারতবর্ষ উপমহাদেশের সর্বপ্রাচীন দুটি কাহিনীর একটি হলো  ‘রামায়ণ ‘ আর অন্যটি ‘মহাভারত ‘।মহাভারত সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে – যা নেই ভারতে তা নেই ভারতে এর অর্থঃ মহাভারত গ্রন্থে যা নেই তা ভারতবর্ষেও নেই অর্থাৎ ভারতবর্ষে ঘটেনি বা গড়তে পারে না । 

মহাভারত আয়তনে বিশাল । ‘রামায়ণ’ তার তুলনায় ক্ষুদ্র ;কাহিনী হলো ঃ পত্নী সীতাকে নিয়ে যুবরাজ রামচন্দ্রের বনবাস তাঁদের অনুগামী হয় কনিষ্ঠ ভ্রাতা ; বনবাসে থাকার সময়ে লস্কা দ্বীপের রাজা রবায়ণ তার বোন শুর্পনখার সম্মান রক্ষার জন্য সীতাকে হরণ করে রথে চড়িয়ে আকাশ পথে  উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে লস্কায় তার বাগান বাড়িতে বন্দি করে রাখে ।

সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম ও রাবণের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় সেটিই রামায়ণ-কথা । অর্থাৎ এককথা  মহাকাব্য হলো অতিশয় দীর্ঘ কাহিনী কবিতা । মহাকাব্যের মূল লক্ষ্য্য গল্প বলা , তবে তাকে গদ্যে না লিখে  পদ্যে লিখতে হয় । 

এর বাইরে আছে সংক্ষিপ্ত আকারের কবিতা ,যা ‘গীতিকবিতা’ হিসেবে পরিচিত । উপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র কিছু  গান ও কবিতা রচনা করলেও তা তাঁর প্রধান দৃষ্টিকর্ম নয় । তিনি বলেছিলেন ঃ বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য ,সেই কাব্যই গীতিকাব্য । 

এই বক্তব্য সর্বাংশে সত্য ।  গীতিকবিতা কবির  অনুভূতির প্রকাশ য়ওয়ায় সাধারণত দীর্ঘকায় হয় না ।  কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে যদি দীর্ঘাও হয় তাতেও অসুবিধে নেই ,  যদি কোভিদ মনের পূর্ণ অভিব্যক্তি সেখানে প্রকাশিত হয়ে থাকে । বাংলা সাহিত্য গীতি কবিতা  আদি নিদর্শন বৈষব কবিতাবলি ।

যদি গীতিকবিতাকে শ্রেণীবিভাজনের  অন্তর্গত করতেই হয় , তাহলে এ রকম  শ্রেণীবিভাগ করা যুক্তিযুক্ত  বলে মনে হয়ঃ  ভক্তিমূলক ( যেমন- রবীন্দ্রনাথ ,অতুলপ্রসাদ ,রামপ্রসাদ ,রজনীকান্তের রচনা ) স্বদেশপ্রীতি মূলক ( যেমন – বঙ্কিমচন্দ্রের ,বন্ধে মাতরম ,রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা গান ) প্রেমমূলক প্রকৃতি বিষয়ক কিন্তু দর্শনাশ্রহী কবিতা ।

শোক গাথা বা শোক আশ্রয় করে লিখিত কবিতাও এর সমপর্যায়ভুক্ত । বাংলা কবিতায় বিশ্বের দুটি ধারার জনক কাজী নজরুল ইসলাম ও জসিম উদ্দিন । প্রথম জন  আমাদের সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি ও দ্বিতীয় জন  পল্লীকবি হিসেবে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন ।

নজরুলের কবিতায় কন্ঠস্বর ও দৃপ্ত ভাবের দেখা মেলে তা পূর্বে বাংলা কাব্যে ছিল না । জসীম উদ্দিনের নকশীকাঁথার  মাঠ  ও সোজনবাদিয়ার ঘাট  জাতীয় কোনো কাব্য পূর্বে কেউ রচনা করেন নি এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর অনুসারী ও কেউ নেই ।

নাটক

বিশ্ব সাহিত্য নাটক সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ।  তবে মনে রাখা দরকার নাটক সেকালে  পুস্থকাকারে মুদ্রিত হয়ে তখন তো  ছাপাখানা ছিল না ।  ঘরে ঘরে পঠিত হতো না ।  নাটক অভিনীত  হতো । 

নাটকের লক্ষ্য পাঠক নয় , নাটকের লক্ষ্য সর্বকালের দর্শকসমাজ । তার কারণ সাহিত্যের সকল শাখার ভিতরে নাটকই একমাত্র যা সরাসরি সমাজকে ও পাঠকগোষ্ঠীকে  প্রভাবিত করতে চায় এবং সক্ষম হয় ।

সংস্কৃত  আলস্কারিকবৃন্দ নাট্যসাহিত্যকে কাব্যসাহিত্যের মধ্যে গণ্য করেছেন । প্রাচীনকালে সে রকমই প্রথা ছিল ।  যেমন, শেক্সপীয়রও তাঁর সকল নাটক কবিতায় রচনা করেছেন ।

সংস্কৃত  আলস্কারিকদের মতে কাব্য দুই ধরনের ঃ দৃশ্যকাব্য  ও  শ্রব্যকাব্য । নাটক প্রধানত দৃশ্যকাব্য  যেহেতু নাটকের অভিনয় মানুষজনকে দর্শন করানোর সম্ভবপর না হলে নাট্য রচনার মূল উদ্দেশ্য এই ব্যর্থ হয় ।

নাটক সচারচর পাঁচ অংকে বিভক্ত থাকেঃ ১ , প্রারম্ভ  ২ ,প্রবাহ (অর্থাৎ কাহিনীর অগ্রগতি ) ৩, উৎকর্ষ বা Climax , 8 গ্রন্থিমোচন (অর্থাৎ পরিণতির দিকে উত্তরণ) , ৫,উপসংহার । 

কাহিনীর বিষয়বস্তু  ও পরিণতির দিক থেকে বিচার করলে নাটককে প্রধানত ট্র্যাজেডি (Tragedy বা   বিয়োগান্ত নাটক ) কমেডি (Comedy) বা মিলনান্ত নাটক ) কমেডি (Comedy বা মিলারান্ত নাটক ) এবং প্রহসন (Force) এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা যায় ।

এদের মধ্যে ট্র্যাজেডিকেই  সর্বশ্রেষ্ঠ জন্য করা হয়। ট্র্যাজেডির ভিতরে দুইটি অংশ ক্রিয়াশীল থাকে ; প্লট ( Plot বা নাটকের আখ্যানভাগ ) চরিত্রসৃষ্টি  সংলাপ চিন্তা বা জীবন দর্শনের  পরিস্ফটন মঞ্চায়ন সমস্ত কিছুর সমন্বয়ে সুরসঙ্গতি । 

গ্রিক দার্শনিক ও সাহিত্যবেওা এরিস্টোটল বলতে চেয়েছেন রঙ্গমঞ্চে নায়ক বা নায়িকার জীবন কাহিনী দৃশ্যপরস্পরা উপস্থাপনের মাধ্যমে যে নাটক দর্শকের হৃদয়ের ভয় ও করুণা প্রশমিত করে তার মনে করুন রসের আনন্দ সৃষ্টি করে,তাই হলো ট্র্যাজেডি ।

কমেডি বিষয়ে  এরিস্টোটলের বক্তব্য এ রকমঃমানবচরিত্রের  যেকৌতুক প্রদো দিক কাউকে  প্রীড়ন করে না ব্যথা দেয় না হাস্যরস সৃষ্টি করে ,  তাই কমেডির উপজীব্য ।

এই কৌতুকের জন্ম ইচ্ছার সঙ্গে বাস্তব অবস্থার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগের উদ্দেশ্যর সঙ্গে উপায়ের বা কথার সঙ্গে কাজের  অসঙ্গতির মধ্যে। কমেডি আমাদের মানবসুলভ ত্রুটিবিচ্যুতি ও নির্বুদ্ধিতার পরিণাম  প্রাদরর্শন করে অশোভন দুর্বলতার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে আমাদের কে সুস্থ ও স্বাভাবিক করে তোলে । 

শ্রেণীবিন্যাসে বিবেচনায় নাটককে বহু শ্রেণীতে বিভক্ত করা সম্ভব । যেমন ধ্রুপদী ( বা ক্ল্যাসিক্যাল ) নাটক রোম্যান্টিক নাটক ।  অথবা ধরা যাক –  কাব্যধর্মী নাটক সামাজিক নাটক চক্রান্তমূলক নাটক ঐতিহাসিক নাটক পৌরাণিক নাটক প্রহসন । 

এসব ব্যতিরেকেও  হতে পারে গীতিনাট্য নৃত্যনাট্য রচিত নাটক উপন্যাসের নাট্যরূপ সাস্কেতিক  নাটক সমস্যা প্রধান নাটক একাস্কিকা ইত্যাদি । ট্র্যাজেডি ও কমেডি  মোটা দাগে এই দুইটি বিভাজন তো রয়েছেই ।

বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে প্রথম যুগান্তকারী প্রতিভা মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং দীনবন্ধু মিত্র । মাইকেলের লেখনীয়তেই সর্বপ্রথম ট্র্যাজেডি কমেডি ও প্রহসন বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয় ।

তারপর দীনবন্ধু আবির্ভূত হন সামাজিক নাটক নিয়ে । তাঁর নীলদর্পণ নাটক এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ ।  পরবর্তী সময়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৪৩–১৯১১) একইসঙ্গে নাট্যকার ও অভিনেতা ছিলেন । 

তিনি পৌরাণিক নাটক ( জানা বুদ্ধদের ) ঐতিহাসিক নাটক ( কালা পাহাড় ) সামাজিক নাটক ( প্রফুল্ল ) ইত্যাদি রচনা করেছেন । দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩–১৯১৩) ঐতিহাসিক নাটক চন্দ্রগুপ্ত ও শাজাহান বাঙালি দর্শকদের হৃদয় জয় করে নেয় ।

তাঁর সমসাময়িকগণের মধ্যে অমৃতলাল বসু ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদদ উল্লেখ্যযোগ্য । আর তার পরেই আবির্ভাব কবি রবীন্দ্রনাথের, যিনি বাংলা নাটকেরও মোড় ঘুরিয়ে দেন নানা দিকে রক্তকরবী ডাকঘর অপরূপরতন প্রতীকধর্মী  নাটক হিসেবে বাংলা সাহিত্য কালজয়ী হয়ে রয়েছে ।

ছোটগল্প

 রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি কবিতায় যা বলেছিলেন সে কথাটি ছোটগল্পের প্রকৃতি সম্পর্কে এখনো  প্রামাণ্য ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে ।  তিনি লিখেছিলেন সে কথাটি  ছোটগল্পে  প্রকৃতি সম্পর্কে এখন ও প্রামাণ্য ব্যাখ্যা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে ।  তিনি লিখেছেনঃ

ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা             ছোট ছোট দুঃখ কথা

 নিতান্তই সহজ সরল 

সহস্র বিস্মৃতি রাশি           প্রত্যহ  যেতেছে ভাসি

    তারি দুচারটি অশ্রুজল ।

নাহি বর্ণনার ছটা               ঘটনার ঘনঘটা

    নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ 

 অন্তরে অতৃপ্তি রবে                  সাঙ্গ কুরি মনে হবে

 শেষ হ,য়ে  হইল না শেষ

শেষ হয়ে হইল না শেষ– কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এ কথার ভিতরেই বলে দেওয়া হল যে ছোটগল্প কখনোই কাহিনীর ভিতরে ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বলে দেয় না– যেমনটা ঘটে উপন্যাসের ক্ষেত্রে । 

বাংলা সাহিত্যে ‘ছোটগল্প’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে  চল্লিস পঞ্চাশ  বৎসরের বেশি নয় ।  তার পূর্বে শুধু ‘গল্প’ বলা হতো । বড়ো আকারের গল্প হলে উপন্যাসিকা কথা চল ছিল ,অর্থাৎ ছোট্ট উপন্যাস

সাহিত্যের যত শাখা আছে,  যেমন কাব্য মহাকাব্য নাটক উপন্যাস ইত্যাদি ,সে সবের মধ্যে ছোট গল্পই হচ্ছে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ।

ছোটগল্পেও থাকে উপন্যাসের মতোই কোনো না  কোনো কাহিনীর বর্ণনা , তবে তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নয় কাহিনীর ভিতরে থেকেই বেছে নেওয়া কোনো অংশ থাকে মাএ ।  

ইংরেজি সাহিত্যের উদাহরণ অনুকরণ করে  বাংলায় যেমন উপন্যাস লিখিত হয়েছে, ছোটগল্পে ও অনুপ্রেরণা এসেছে পাশ্চাত্য সাহিত্য থেকেই । ‘ছোটগল্প’ বলতে কোন ধরনের কাহিনী বোঝাবে সে বিষয়ে বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন  ছোটগল্পকার  এডগার অ্যালান  পো-কে ছোটগল্পের  জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয় ।

  তিনি লিখেছেন In the whole composition there should be no word written of which the tendency , direct or indirect is not to the one pre-established design –undue brevity is just as exceptional here as in the poem,but undue length is yet more to be avoided.

বলাই বাহুল্য , উপন্যাসে যেমন বিস্তারিতভাবে কাহিনী বর্ণনা থাকে , ছোট গল্পের পরিধি ক্ষুদ্র হওয়ার কারণে ঘটনার  পুঙ্খানুুপুুুঙখ উপস্থাপন সেখানে সম্ভব নয় এবং প্রয়োজনীয় ও বটে । সাহিত্য গবেষক শ্রীশচন্দ্র  দাশ যথার্থই বলেছেন ।