বাংলাদেশের সংবিধান

বাংলাদেশের সংবিধানের পূর্ণ নাম কি?

বাংলাদেশের সংবিধানের পূর্ণ নাম হলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। এটি ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের তৎকালীন গণপরিষদের দ্বারা গৃহীত হয় এবং ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়।

সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সংসদীয় প্রজাতন্ত্র।”

সংবিধানে ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকারের শাখা, মৌলিক অধিকার, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়গুলির বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। এটি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন।

প্রস্তাবনা কি বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ

প্রস্তাবনা বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদটিই প্রস্তাবনা। প্রস্তাবনাটি সংবিধানের মূলনীতিগুলি সংজ্ঞায়িত করে। এটি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটায়।

প্রস্তাবনাটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে। তারা অঙ্গীকার করে যে, যে সকল মহান আদর্শ তাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।

প্রস্তাবনাটিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।

প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতিগুলিকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এটি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটায়। তাই প্রস্তাবনাটি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলাদেশের সংবিধানে কয়টি ভাগ আছে

বাংলাদেশের সংবিধানে এগারোটি ভাগ রয়েছে। এগুলি হলো:

  • প্রস্তাবনা
  • প্রথম ভাগ: রাষ্ট্র
  • দ্বিতীয় ভাগ: নাগরিকত্ব
  • তৃতীয় ভাগ: মৌলিক অধিকার
  • চতুর্থ ভাগ: সরকারের শাখা
  • পঞ্চম ভাগ: আইন প্রণয়ন
  • ষষ্ঠ ভাগ: বিচার
  • সপ্তম ভাগ: অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
  • অষ্টম ভাগ: শিক্ষা ও সংস্কৃতি
  • নবম ভাগ: স্থানীয় সরকার
  • দশম ভাগ: বিবিধ
  • একাদশ ভাগ: সংশোধন

প্রস্তাবনাটি সংবিধানের একটি অংশ হলেও এটিকে ভাগ হিসেবে গণ্য করা হয় না।

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্য কয়টি ও কি কি?

বাংলাদেশের সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

  • লিখিত সংবিধান: বাংলাদেশের সংবিধান একটি লিখিত সংবিধান। এটি একটি দলিল আকারে রচিত এবং এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, সরকারের শাখা, মৌলিক অধিকার, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়গুলির বিধান রয়েছে।
  • দুষ্পরিবর্তনীয়: বাংলাদেশের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয়। এটি সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন।
  • সামাজিক ন্যায় ও সাম্য ভিত্তিক: বাংলাদেশের সংবিধান সামাজিক ন্যায় ও সাম্য ভিত্তিক। এতে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
  • ধর্মনিরপেক্ষ: বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ। এতে সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
  • গণতান্ত্রিক: বাংলাদেশের সংবিধান গণতান্ত্রিক। এতে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার বিধান রয়েছে।
  • সংসদীয় প্রজাতন্ত্র: বাংলাদেশের সংবিধান সংসদীয় প্রজাতন্ত্রের। এতে সংসদকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত জনগণের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠন করার বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের এই বৈশিষ্ট্যগুলি বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সুষ্ঠু ও সুসংহতভাবে পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশের সংবিধান কিভাবে প্রণীত হয়

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ:

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর, ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

নির্বাচিত সংসদকে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংসদ ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন খসড়া সংবিধান বিল আকারে উত্থাপন করেন।

গণপরিষদের সদস্যরা খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা করেন এবং বিভিন্ন সংশোধনী প্রস্তাব করেন। গণপরিষদের অধিবেশনগুলিতে বহুবিধ বিতর্ক ও আলোচনার মধ্য দিয়ে সংবিধানের চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করা হয়।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের প্রথম বার্ষিকীতে সংবিধান কার্যকর হয়।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও, বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, সামাজিক সংগঠন ইত্যাদির প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করা হয়েছিল।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য কে?

বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন বেগম রাজিয়া বানু। তিনি ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নাতনি। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের শিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় সচিব। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারি আসনের এমএনএ ছিলেন।

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন কে?

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি নিযুক্ত হন ড. কামাল হোসেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ। তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কমিটির নেতৃত্বে ১৯৭২ সালের ১০ জুন খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেন। গণপরিষদে খসড়া সংবিধানের উপর আলোচনা ও সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান গৃহীত হয়।

ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম রূপকার।

মৌলিক অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানের কত নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত রয়েছে?

বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার বর্ণিত রয়েছে। এই ভাগে ১১২ থেকে ১৫৩ নং অনুচ্ছেদ পর্যন্ত মোট ৪২টি অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকারের বিধান রয়েছে।

মৌলিক অধিকারগুলিকে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:

  • ব্যক্তিগত অধিকার: এই অধিকারগুলি ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে জীবনের অধিকার, ব্যক্তির স্বাধীনতা, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রার স্বাধীনতা, বিচারের অধিকার, আইনের আশ্রয়লাভের অধিকার ইত্যাদি।

  • সামাজিক অধিকার: এই অধিকারগুলি ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, কর্মসংস্থানের অধিকার, শ্রম অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার ইত্যাদি।

  • রাজনৈতিক অধিকার: এই অধিকারগুলি ব্যক্তির রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করে। এই অধিকারগুলির মধ্যে রয়েছে ভোটাধিকার, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার, রাজনৈতিক মত প্রকাশের অধিকার, সরকারের সমালোচনা করার অধিকার ইত্যাদি।

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য কে ছিলেন?

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তিনি ন্যাপ দলের সদস্য ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে তিনি একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সংবিধানের বিভিন্ন বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯২৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি একজন আইনজীবী এবং রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২ সালের গণপরিষদে তিনি সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি নির্বাসিত হন। ১৯৯২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। ২০০১ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *