কোষ বিভাজন

কোষ বিভাজন কে আবিষ্কার করেন?

কোষ বিভাজনের আবিষ্কারটি ১৮৮২ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়াল্টার ফ্লেমিং করেন। তিনি সামুদ্রিক সালামান্ডার (Triturus maculosa) কোষে প্রথমবারের মতো কোষ বিভাজন লক্ষ্য করেন। তিনি দেখতে পান যে কোষের নিউক্লিয়াস দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটিকে মাইটোসিস বলা হয়।

ফ্লেমিংয়ের আবিষ্কারের আগে, বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে কোষগুলি অমর এবং তারা কখনই বিভাজিত হয় না। ফ্লেমিংয়ের আবিষ্কারটি কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছিল এবং এটি কোষ জীববিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসাবে বিবেচিত হয়।

ফ্লেমিংয়ের আবিষ্কারের পর, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা কোষ বিভাজনের প্রক্রিয়াটি আরও বিশদে অধ্যয়ন করেন। এই গবেষণার ফলে কোষ বিভাজনের দুটি প্রধান ধরন আবিষ্কৃত হয়: মাইটোসিস এবং মিয়োসিস।

মাইটোসিস হল কোষ বিভাজনের একটি প্রক্রিয়া যা জিনগতভাবে অভিন্ন দুটি কোষ তৈরি করে। এটি কোষের বৃদ্ধি এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোষের প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করে।

মিয়োসিস হল কোষ বিভাজনের একটি প্রক্রিয়া যা জিনগতভাবে ভিন্ন চারটি কোষ তৈরি করে। এটি প্রজননে ব্যবহৃত হয়।

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন কেন হয়?

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের অনেকগুলি কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • জিনগত পরিবর্তন: জিনগত পরিবর্তনগুলি কোষের বিভাজন নিয়ন্ত্রণকারী জিনগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন হতে পারে। জিনগত পরিবর্তনগুলিতে ত্রুটিযুক্ত জিন, রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসা, বা বিকিরণ হতে পারে।
  • পরিবেশগত কারণ: কিছু পরিবেশগত কারণগুলি, যেমন ভারী ধাতব, রাসায়নিক, বা বিকিরণ, অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • বয়স: বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোষগুলি অস্বাভাবিকভাবে বিভাজিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
  • অতিরিক্ত হরমোন: অতিরিক্ত হরমোন, যেমন ইস্ট্রোজেন, অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • অতিরিক্ত ওজন: অতিরিক্ত ওজন অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের কিছু নির্দিষ্ট উদাহরণ হল:

  • ক্যান্সার: ক্যান্সার হল কোষের অস্বাভাবিক বিভাজনের ফলে সৃষ্ট একটি রোগ। ক্যান্সার কোষগুলি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বিভাজিত হয় এবং ছড়িয়ে পড়ে।
  • পোলিপ: পোলিপ হল কোষের একটি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি যা ত্বক বা মিউকাস মেমব্রেনের উপর হতে পারে। পোলিপগুলি ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।
  • মায়োমিয়াম: মায়োমিয়াম হল জরায়ুর পেশীবহুল টিস্যুর একটি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। মায়োমিয়াম সাধারণত ক্যান্সার নয়, তবে এগুলি ব্যথা এবং অন্যান্য সমস্যার কারণ হতে পারে।

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের লক্ষণগুলি নির্ভর করে কোষের অবস্থানের উপর। সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • ফোলাভাব
  • রক্তপাত
  • বেদনা
  • অস্বাভাবিক বৃদ্ধি

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের সন্দেহ হলে একজন ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নির্ণয় নিশ্চিত করতে পারেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে রয়েছে:

  • শারীরিক পরীক্ষা
  • রক্ত পরীক্ষা
  • চিত্রায়ন পরীক্ষা, যেমন এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ড, বা সিটি স্ক্যান
  • টিস্যু বা কোষের নমুনার বায়োপসি

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের চিকিৎসা নির্ভর করে অবস্থার উপর। কিছু ক্ষেত্রে, চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে, চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে:

  • ওষুধ
  • অস্ত্রোপচার
  • রেডিয়াশন থেরাপি

অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ঝুঁকি কমাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • স্বাস্থ্যকর খাবার খান
  • নিয়মিত ব্যায়াম করুন
  • স্বল্প মাত্রার অ্যালকোহল পান করুন
  • ধূমপান করবেন না
  • নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন

কোষ বিভাজনে কোষের কোন অংশ জড়িত

কোষ বিভাজনে কোষের নিম্নলিখিত অংশগুলি জড়িত:

  • নিউক্লিয়াস: নিউক্লিয়াস হল কোষের কেন্দ্রীয় অংশ যা ডিএনএ এবং অন্যান্য জিনগত উপাদান ধারণ করে। কোষ বিভাজনের সময়, নিউক্লিয়াস দুটি ভাগে বিভক্ত হয়।
  • ক্রোমোজোম: ক্রোমোজোম হল ডিএনএর দীর্ঘ স্ট্র্যান্ড যা জিন ধারণ করে। কোষ বিভাজনের সময়, ক্রোমোজোমগুলি প্রতিলিপি হয়, যা তাদের জিনগত তথ্যের একটি সঠিক অনুলিপি তৈরি করে।
  • সেন্ট্রোমিয়ার: সেন্ট্রোমিয়ার হল ক্রোমোজোমের একটি সংকীর্ণ অংশ যা একটি কোষের মাঝখানে অবস্থিত। কোষ বিভাজনের সময়, সেন্ট্রোমিয়ারগুলি ক্রোমোজোমগুলিকে একসাথে ধরে রাখে এবং তাদের সঠিকভাবে বিভাজন করতে সাহায্য করে।
  • মেট্যাফেজ প্লেট: মেটাফেজ প্লেট হল কোষের মাঝখানে অবস্থিত একটি প্লেট যা ক্রোমোজোমগুলিকে ধারণ করে। কোষ বিভাজনের সময়, ক্রোমোজোমগুলি মেটাফেজ প্লেটে সংযুক্ত হয়।
  • সাইটোকাইনেসিস: সাইটোকাইনেসিস হল কোষের সাইটোপ্লাজম এবং অঙ্গাণুগুলির বিভাজন। কোষ বিভাজনের সময়, সাইটোকাইনেসিস কোষটিকে দুটি নতুন কোষে বিভক্ত করে।

কোষ বিভাজনের সময়, এই অংশগুলি একসাথে কাজ করে জিনগতভাবে অভিন্ন দুটি কোষ তৈরি করতে।

কোষ চক্র কি

কোষ চক্র হল কোষের জীবনের একটি পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া যা কোষের বৃদ্ধি, বিভাজন এবং মৃত্যুর নিয়ন্ত্রণ করে। কোষ চক্রটি চারটি প্রধান পর্যায় নিয়ে গঠিত:

  • G1 পর্যায়: এই পর্যায়ে, কোষ বৃদ্ধি পায় এবং জিনগত উপাদানগুলির জন্য প্রস্তুত হয়।
  • S পর্যায়: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি প্রতিলিপি হয়, যা তাদের জিনগত তথ্যের একটি সঠিক অনুলিপি তৈরি করে।
  • G2 পর্যায়: এই পর্যায়ে, কোষ বিভাজনের জন্য প্রস্তুত হয়।
  • M পর্যায়: এই পর্যায়ে, কোষটি দুটি নতুন কোষে বিভক্ত হয়।

কোষ চক্রটি একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া যা কোষের স্বাস্থ্য এবং কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। কোষ চক্রের কোনও পর্যায়ে সমস্যা হলে, এটি কোষের বৃদ্ধি, বিভাজন বা মৃত্যুর ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

কোষ চক্রের প্রতিটি পর্যায়ের একটি নির্দিষ্ট কাজ রয়েছে:

G1 পর্যায়:

  • কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে।
  • জিনগত উপাদানগুলির জন্য প্রস্তুত হয়।

S পর্যায়:

  • ক্রোমোজোমগুলি প্রতিলিপি করে।

G2 পর্যায়:

  • কোষ বিভাজনের জন্য প্রস্তুত হয়।

M পর্যায়:

  • কোষটিকে দুটি নতুন কোষে বিভক্ত করে।

কোষ চক্রের সময়কাল কোষের ধরন এবং অবস্থার উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ, প্রাণী কোষগুলির কোষ চক্রের সময়কাল প্রায় 24 ঘন্টা, যখন উদ্ভিদ কোষগুলির কোষ চক্রের সময়কাল প্রায় 24-72 ঘন্টা হতে পারে।

কোষ চক্রের নিয়ন্ত্রণে অনেকগুলি জিন জড়িত। এই জিনগুলি কোষ চক্রের প্রতিটি পর্যায়ের শুরু, সময়কাল এবং শেষ নিয়ন্ত্রণ করে।

কোষ বিভাজন কত প্রকার

কোষ বিভাজন প্রধানত দুই প্রকার:

  • অ্যামাইটোসিস
  • মাইটোসিস

অ্যামাইটোসিস হল কোষ বিভাজনের একটি সরল প্রক্রিয়া যা বেশিরভাগ প্রোকারিওটিক কোষ এবং কিছু ইউক্যারিওটিক কোষে দেখা যায়। অ্যামাইটোসিসে, কোষের নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম সরাসরি বিভক্ত হয়। অ্যামাইটোসিস সাধারণত কোষের ক্ষতি বা সংকোচনের কারণে ঘটে।

মাইটোসিস হল কোষ বিভাজনের একটি জটিল প্রক্রিয়া যা বেশিরভাগ ইউক্যারিওটিক কোষে দেখা যায়। মাইটোসিসে, কোষের নিউক্লিয়াস দুটি সমান অংশে বিভক্ত হয়, প্রতিটি অংশে ক্রোমোজোমের একটি সম্পূর্ণ সেট থাকে। মাইটোসিস কোষের বৃদ্ধি, ক্ষতি বা প্রতিস্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয়।

মাইটোসিসকে সাধারণত চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়:

  • প্রোফেজ: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি সংকুচিত হয় এবং সেন্ট্রোমিয়ারগুলিতে সংযুক্ত হয়।
  • মেটাফেজ: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি মেটাফেজ প্লেটে সাজানো হয়।
  • অ্যানাফেজ: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি কোষের দুটি মেরুতে চলে যায়।
  • টেলোফেজ: এই পর্যায়ে, নিউক্লিয়ার মেমব্রেন এবং নিউক্লিওলাস পুনর্গঠিত হয় এবং সাইটোপ্লাজম বিভক্ত হয়।

মাইটোসিসের গুরুত্ব:

  • কোষের বৃদ্ধি: মাইটোসিস কোষের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন একটি কোষ বৃদ্ধি পায়, তখন এটি মাইটোসিস দ্বারা দুটি নতুন কোষে বিভক্ত হয়।
  • ক্ষতি বা প্রতিস্থাপন: মাইটোসিস ক্ষতিগ্রস্ত বা মারা যাওয়া কোষগুলির প্রতিস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন একটি কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা মারা যায়, তখন মাইটোসিস দ্বারা নতুন কোষ তৈরি হয়।
  • প্রজনন: প্রজননে মাইটোসিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন একটি জীব বংশবৃদ্ধি করে, তখন এর কোষগুলি মাইটোসিস দ্বারা বিভক্ত হয়।

মিয়োসিস হল কোষ বিভাজনের একটি জটিল প্রক্রিয়া যা জনন কোষ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। মিয়োসিসে, একটি মাতৃকোষ চারটি অপত্য কোষে বিভক্ত হয়, প্রতিটি অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের অর্ধেক সংখ্যক থাকে। মিয়োসিস দুটি পর্যায়ে বিভক্ত:

  • মিয়োসিস I: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি মিলিত হয় এবং আন্তঃক্রোমোজোমাল বিনিময় ঘটে।
  • মিয়োসিস II: এই পর্যায়ে, ক্রোমোজোমগুলি বিভক্ত হয় এবং সাইটোপ্লাজম বিভক্ত হয়।

মিয়োসিসের গুরুত্ব:

  • প্রজনন: মিয়োসিস জনন কোষ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনন কোষগুলিতে ক্রোমোজোমের অর্ধেক সংখ্যক থাকে, যা তাদের নতুন জীব তৈরি করার জন্য অন্য জনন কোষের সাথে মিলিত করতে দেয়।
  • বৈচিত্র্য: মিয়োসিস বৈচিত্র্য তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তঃক্রোমোজোমাল বিনিময়ের ফলে নতুন জিনগত সংমিশ্রণ তৈরি হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *