আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কে ছিলেন

১৯৫৫সালের অক্টোবরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম রাখা হয় । আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ।

ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে এবং মুসলিম লীগ নেতাদের ও  অগণতান্ত্রিক মনোভাব ও সরকারের ভ্রান্তনীতির প্রতিবাদে মূলত আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয় ।

মাওলানা ভাসানী এবং  সোহরাওয়ার্দী  গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিয়ম তান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা ও জনগণের লক্ষ্যে আওয়ামী ‘’মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা’’ করেন । বিশিষ্ট জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন । 

পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের জনস্বার্থহীন কার্যকলাপ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ও সামন্তপ্রভুদের তুষ্ট করার মনোভাবে পূর্ব বাংলার জনগণ বিশেষ করে শিক্ষিত সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশ প্রগতিশীল আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়ে ।

কিছুদিনের মধ্যে মাওলানা ভাসানী, সরোয়ারদী ও শেখ মজিবুরের যোগ্য নেতৃত্বে এবং ছাত্র সমাজের সক্রিয় সমর্থনে আওয়ামী লীগ জনপ্রিয় দল হিসেবে পরিগণিত হয় ।

দেশ বিভাগের বহু পূর্ব হতেই বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগের ভিতরে  সোরওয়ার্দী হাসিম এবং খাজা গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল ।  একে অনেকে উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও সমান্ত শাসক শ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলে আখ্যায়িত করেন । 

সহজ করে এ অবস্থাকে বলা যায় জনসাধারণ ও প্রাসাদের দ্বন্দ্ব ।  দেশ বিভাগ পরিকল্পনার নীতিমালা অনুযায়ী বাংলার মুসলমান প্রধান এলাকাকে ( পূর্ববাংলার)  নিয়ে  একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে ওঠে যাকে পাকিস্তানের পূর্বাচল বা পূর্ব পাকিস্তান বলা হতো ।

পাকিস্তানভুক্ত পূর্ববাংলার  রাজনৈতিক নেতৃত্ব খাজাগ্রুপের হাতে চলে যায় ।  আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ বিভাগের ঘোষণার আগেই মুসলিম লীগ হাইকমান্ড  পূর্ব বাংলার আইনসভার জন্য পার্লামেন্টারি নেতা হিসেবে খাজা নাজিমউদ্দিনকে নির্বাচিত করেন ।

সোহরাওয়ার্দী ও  হাশিম পূর্ব বাংলায় আসার পরে প্রথমে রাজনৈতিকভাবে তাদের অবস্থান কেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না ।  মুসলিম লীগের ও অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য লক্ষ্যে একটি গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।

১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন তারিখে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ।

প্রশাসন ও সামরিক বিভাগে বাঙালি নিয়োগের ব্যাপারে অসমতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ও সরকারের দুর্নীতি এবং সর্বোপরি মুসলিম লীগের প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধেপূর্ব বাংলার জনগণ ক্রমশ বিক্ষুদ্ধ হতে থাকে ।

ফলে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের যেমন জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়, তেমনি আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে ।  এদিকে যতোই সময় অতিবাহিত হতে থাকে মুসলিম লীগ সরকার ততই আমরা সেনাবাহিনী নির্ভর হতে থাকে ।

সেনাবাহিনীর সমর্থনে আমরা গভর্নর জেনারেল গোলাম  মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনকে পদচ্যুত করেন ।  তাঁর স্থলে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার  মুহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন ।

কিন্তু মুহাম্মদ আলীর মুসলিম লীগের ওপর তেমন শক্তিশালী প্রভাব ছিল না এবং বাঙালি হওয়ায় দলের মধ্যে মর্যাদার অভাব ছিল । এসব কারণে তাঁর ক্ষমতা ছিল পুতুল প্রধানমন্ত্রীর মতো সীমিত ।

এ  ছাড়া পাঞ্জাবি মিলিটারি গোষ্ঠী এবং আমলারাই ছিল দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা । এদেরই চক্রান্তে পাকিস্তান মার্কিন সামরিক চুক্তি হয় । এ এর কারণেই বাঙালিরা আওয়ামী লীগের দিকে  ঝুঁকে পড়ে এবং পরিতানের পথ খুঁজতে থাকে । 

১৯৪৭সালের ১৪ আগস্ট দেশ বিভাগের পরে ১৯৫৪ সালের মার্চের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় কোন নির্বাচন হয় নি । জনগণ নির্বাচন প্রত্যাশা করেও কোন লাভ হয় নি । 

মুসলিম লীগ বুঝতে পেরেছিল যে নির্বাচন দিলে ফলাফল তাদের পক্ষে নাও যেতে পারে । শেষ পর্যন্ত ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে । ইতোমধ্য আওয়ামী লীগ ও ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি (K. s . p) সরকার বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে ।

ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে নির্বাচনী যুদ্ধে জয়লাভ করতে হলে সরকার বিরোধী শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ।  শেষ পর্যন্ত তরুণ ছাত্রসমাজ ও প্রগতিবাদীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঐক্য জোর গঠনের লক্ষ্য ১৯৫৩ সালের ৩ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় ।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘নৌকা’ এবং মুসলিম লীগে নির্বাচনী প্রতীক ছিল ‘হারিকেন’ । যুক্তফ্রন্টের ম্যানিফেস্টো ছিল ঐতিহাসিক ২১ দফা ।  ২১ দফার ভিত্তিতে পূর্ববাংলার আপামর জনগণ ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে আবাধ ও সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে । নিচে  একুশ দফা উপস্থাপন করা হল ।

 ২১ দফা কর্মসুচি

সুন্নাহর  মৌলিক নীতির প্রতিকূল কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবনধারণের ব্যবস্থা করা হবে ।

১। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদার ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী  স্বত্ব উচ্ছেদ ও  রহিত করে ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হবে এবং উচ্চহারের খাজনা   ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হবে এবং সার্টিফিকেট যোগে  খাজনা আদায়ের প্রথা রোহিত করা হবে ।

২। পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্য তা পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনায়ন করে পাটচাষীদের  পাটের ন্যায্য মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে ।

এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের  পাট  কেলেংকারির তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শান্তির ব্যবস্থা ও তাদের  অসদু পায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হবে ।

৩। শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর গভীর মোহাজেদের আশু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা হবে ।

৪।  খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে ।

৫। পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করে ও কৃষিকে আধুনিক যোগপযোগী করে শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হবে এবং সব ধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হবে।

৬। দেশের  সর্বএ একযোগে প্রাথমিক ও   আবৈর্তনিকবাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে এবং শিক্ষকদের   ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হবে ।

৭। খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করে দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কবল থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হবে । 

৮ । কিসের উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা পরিবর্তন করা  হবে ও সরকারি সাহায্য সকল প্রকার কুটির ও অস্ত্র শিল্পের উন্নতি সাধন করা হবে । 

৯। শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল সংস্কার করে শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকর করে কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে ।

একই পর্যায়েভুক্ত করে সব বিদ্যালয়সমূহকে সরকারি সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হবে এবং শিক্ষকদের ব্যবস্থা করা হবে ।

১০। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-কানুন বাতিল ও রহিত করে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বয়ওশাসিত প্রতিষ্ঠানের পরিণত করে উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হবে এবং অল্প ব্যয়সাসাপেক্ষ ও সুবিধাজনক ছাত্রাবাসে বন্দোবস্ত করা হবে । 

১১।  শাসনব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হবে এবং তদুদ্দেশ্যে  উচ্চ বেতন রোগীদের বেতন কমিয়ে ও নিম্ন বেতনভোগীদের বেতন বাড়িয়ে তাদের আয়ের এবং একটি সুসংহত সামঞ্জস্য বিধান করা হবে । যুক্তফ্রন্টের কোন মন্ত্রী এক হাজার টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না ।

১২।দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ঘুষ রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হবে এবং এতদূদ্দেশ্য সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি পদাধিকারী ও ব্যবসায়ীর ১৯৪০  সাল হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ নেওয়া হবে এবং সন্তোষজনক  কৈফিয়ং দিতে না পারলে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে ।

১৩। বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা হবে ।

১৪। বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও করে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পূর্ণিমারত করা হবে ।

১৫। জননিরাপত্তা আইন অর্ডিন্যান্স প্রবৃত্তি কালাকানুন  রদ ও রহিত করে বিনা বিচারে আটক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হবে এবং সংবাদপত্র ও সভা সমিতি করার অধিকার অবাধ ও নিরস্কুশ করা হবে ।

১৬। বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে ।

১৭।  বাংলার রাষ্ট্রভাষার দাবিতে যারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হয়েছেন তাঁদের পবিত্র  স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি তৌহিদ মিনার নির্মাণ করা হবে এবং তাঁদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে ।

১৮। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে  শহীদ দিবস ঘোষণা করে একে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে ।

১৯ ।লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ কে পূর্ণ স্বায়ওশাসনপ্রদান করা হবে এবং দেশরক্ষা , পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় ( অবশিষ্ট ক্ষমতা সমূহ) পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে কোন বাহিনী হেডকোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তান স্থাপন করা হবে ।

এবং পূর্ব পাকিস্তানের অস্ত্র নির্মাণের কারখানা করে পূর্ব পাকিস্তানকে আত্মরক্ষায় সম্পূর্ণ করা হবে । আনসার বাহিনীকে সমস্ত বাহিনীতে পরিণত করা হবে ।

২০। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াবে না ।  আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ৬ মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে নির্বাচন কমিশন মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন ।

২১। যুক্তফ্রন্টের আমলে যখন যে আসন শূন্য হবে তিন মাসের মধ্যে তা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে এবং পরপর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থীর পরাজিত হলে মন্ত্রিসভার স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে ।

বস্তুতঃপক্ষে, ২১ দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ । প্রধানত স্বায়ত্তশাসনের দাবিই ছিল এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের ভিত্তি ।  এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট শোচনীয়ভাবে  প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগকে পরাজিত করে পরিষদের মোট আসন সংখ্যা ৩০৯টির মধ্যে যুক্তফ্রন্ট এককভাবে ২২৩টি আসল লাভ করে ।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করে ।  মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীনসহ মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পাঁচ জন প্রভাবশালী সদস্য পরাজয় বরণ করেন ।  বাঙালির স্বাধিকার কার অর্জনের ইতিহাসে এই নির্বাচনের গুরুত্ব অনেক বেশি । 

যুক্তফ্রন্টের এই  ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশে-বিদেশে ব্যালট বাক্সর মাধ্যমে বিপ্লব বলে আখ্যায়িত হয়েছে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *