পরিবেশ দূষণ কী
পরিবেশ দূষণ হল পরিবেশের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের যে অবাঞ্ছিত পরিবর্তন জীবের জীবনধারণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তাকেই দূষণ বলে। ক্ষতিকর পদার্থ পরিবেশের উপাদানসমূহে যুক্ত হলে তাকে পরিবেশ দূষণ বলে।
পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:
- বায়ু দূষণ: বায়ু দূষণ হল বায়ুমণ্ডলে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি যা মানুষের স্বাস্থ্য, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বায়ু দূষণের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: যানবাহন, শিল্প, কৃষি এবং বাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়াশা এবং গ্যাস।
- জল দূষণ: জল দূষণ হল জলে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি যা পানীয়, কৃষি এবং শিল্পের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। জল দূষণের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: শিল্প বর্জ্য, কৃষি রাসায়নিক এবং বাড়ি থেকে বর্জ্য।
- মৃত্তিকা দূষণ: মৃত্তিকা দূষণ হল মাটিতে ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি যা উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। মৃত্তিকা দূষণের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: শিল্প বর্জ্য, কৃষি রাসায়নিক এবং বাড়ি থেকে বর্জ্য।
- শব্দ দূষণ: শব্দ দূষণ হল পরিবেশে অবাঞ্ছিত শব্দের উপস্থিতি যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রাণীর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শব্দ দূষণের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: যানবাহন, শিল্প এবং বাড়ি থেকে আসা শব্দ।
- রেডিওঅ্যাক্টিভ দূষণ: রেডিওঅ্যাক্টিভ দূষণ হল পরিবেশে ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় পদার্থের উপস্থিতি যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রাণীর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রেডিওঅ্যাক্টিভ দূষণের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে: পারমাণবিক পরীক্ষা, পারমাণবিক দুর্ঘটনা এবং চিকিৎসা থেরাপি।
পরিবেশ দূষণের প্রভাবগুলির মধ্যে রয়েছে:
- মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি: পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার কারণ হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা, ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং জন্মগত ত্রুটি।
- উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনের ক্ষতি: পরিবেশ দূষণ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, যার ফলে প্রজাতির বিলুপ্তি হতে পারে।
- পরিবেশের ক্ষতি: পরিবেশ দূষণ পরিবেশের ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, যার ফলে বন্যা, খরা এবং আবহাওয়ার অন্যান্য পরিবর্তন হতে পারে।
পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে
- পরিবেশগত আইন ও নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন: পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য আইন ও নীতি প্রণয়ন করা এবং সেগুলি বাস্তবায়ন করা জরুরি।
- পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি: পরিবেশ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
- পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার: পরিবেশ দূষণ কমাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা জরুরি।
পরিবেশ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা যা আমাদের গ্রহের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। পরিবেশ দূষণ রোধের জন্য আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।
তবে বিশ শতকের শেষে পরিবেশবিজ্ঞানীরা এর যে সব কারণ চিহ্নিত করেছেন সেগুলো হলো
(ক) জনসংখ্যাঃ জনসংখ্যা চাপ একটি লোকাল কতটুকু ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ঢাকা মহানগরী । ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা চাপে ঢাকা বিশ্বের অন্যতম দূষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে ।
(খ) বৃক্ষনিধন ও মলুকরণঃ সুস্থ পরিবেশের জন্য কোনো ভূখণ্ডের ২৫%বনভূমি থাকা খুবই জরুরি, যা পৃথিবীর বহু দেশে নেই । বর্তমানে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষনিবধন হার ১ঃ৩।অর্থাৎ প্রতিবছর গড়ে ৬০ লাখ বৃক্ষ ও উজার হচ্ছে ।
(গ) রাসায়নিক দ্রব্য ও কীটনাশক ব্যবহারঃ উন্নত ও অধিক ফসল ফলানোর জন্য কৃষকরা অপরিকল্পিতভাবে জমিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে ।
এর ফলে জীবজগৎ ও পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যেের অনিয়ন্ত্রিত ও ইচ্ছাধীন ব্যবহার এবং প্রয়োগও পরিবেশদূষণের কারণ ।
(ঘ) বায়ুদূষণঃ কল-কারখানার বর্জ্য পদার্থ যেমন পানি দূষণে মূল ভূমিকা রাখে, তেমনই এর কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণেও ভূমিকা রাখছে । গাড়ির কালো ধোঁয়া ও বায়ু দূষণের প্রধান কারণের একটি ।
সংস্থার মান অনুযায়ী বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২০০-৪০০ মাইক্রোগ্রাম । অথচ ঢাকায় গড় পরিমাণ ৭০০-১৮০০ মাইক্রোগ্রাম ।
অন্যদিকে বাতাসে সীসার গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৩৫ পিপিএম । পৃথিবীর অধিকাংশ শহরে এর মাত্রা ৪০০ পিপিএমের বেশি । এহেন বায়ুদূষণের ফলে পরিবেশদূষিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে ।
(ঙ) পানিদূষণঃ পৃথিবীর মোট পানির ৬০% কলুষিত । কল কারখানার বজ্র পদার্থ পানিদূষণের অন্যতম কাজ । শিল্প বিপ্লবের পর পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই পানি দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে ।
(চ) শব্দদূষণঃ মানুষ বৃদ্ধের সাথে সাথে নগর মহানগরের যান্ত্রিকতা বৃদ্ধি পাওয়ার শব্দ দূষণ তীব্রত হচ্ছে । প্রকারান্তরে যা পরিবেশ কেই দূষিত করছে ।
(ছ)পলিথিনঃ পরিবেশদূষণের ক্ষেত্রে পলিথিন একটি বড় ভূমিকা পালন করছে । বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে । আমাদের পলিথিনের যাত্রা শুরু আশির দশকের গোড়ার দিকে ।
পলিথিন বর্জ্য হিসেবে এক ভয়াবহ শত্রু । তবুও আমাদের দেশে আশঙ্কাজনকভাবে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে চলছে । পলিথিন কখনো শেষ হয় না । পলিথিন পোড়ালে পরিবেশের জন্য ক্ষতিক ধোয়া বের হয় ।
বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালের ১ মার্চ চ পলিথিনের শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ করলেও পুরোপুরি এর ব্যবহার বন্ধ হয়নি ।
(জ )প্লাস্টিক সামগ্রীঃ প্লাস্টিক সামগ্রী পলিথিনের পাশাপাশি আর একটি পরিবেশদূষণকারী বস্তু । প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার ও কম নয় । প্লাস্টিক সামগ্রী বা বস্তু মাটির জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে এবং মাটির মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে ।
প্লাস্টিক পোড়ালে হাইড্রোজেন সায়ানাইট গ্যাস বের হয়, যা চাম চামড়ার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর ।
প্রতিকারঃ পরিবেশদূষণ প্রতিরোধকল্পে প্রতিবছর ৫ জুন জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হচ্ছে । কিন্তু তা আন্তরিকতাবর্জিত, বাকসর্বস্ব এক নিস্প্রাণ আনুষ্ঠানিকতামাত্র ।
বিশ্বের জ্ঞানপাপীর দল বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করে , বিশ্বের পরিবেশ দূষণের জন্য অশ্রু বর্ষণ করে, আবার জ্ঞাতসারে সমানে পরিবেশ দূষণ ও করে চলে । এ এক আত্মঘাতী মানসিকতা লক্ষণ ।
আর অরণ্য নিধন নয়- প্রতিটি মানুষের জন্য চাই আনুপাতিক অরণ্য সৃষ্টি । কার্বন মনোস্কাইডের হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য পুরনো গাড়িগুলোকে বাতিল করা দরকার ।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে রকেট নিক্ষেপ রাসায়নিক ও জীবাণু বোমা এবং পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ নিষিদ্ধ হওয়া দরকার সর্বাগ্র।
তাই নতুন শতাব্দীর পরিবেশকে নির্মল করার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে । সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিবেশ বিপর্যয় রোধ পরতে হবে । পরিবেশ বিপর্যয় রোধে নিম্নলিখিত পন্থা গুলো অবলম্বন করতে হবে ।
(ক ) বনায়নঃ বনায়ন পরিবেশদূষণ রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । পরিবেশদূষণের ভয়াবহ ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বনায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
আর বলয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমাদের দেশের জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে । আমাদের বেশি করে গাছের চারা রোপন করতে হবে । যেখানেই খালি জায়গা পাওয়া যাবে, সেখানেই বৃক্ষরোপণ বা বনায়ন করতে হবে ।
এভাবে যদি সবাই এগিয়ে আসতে পারি, তবেই পরিবেশ দূষণ রোধ সম্ভব ।
খ শব্দদূষণ রোধঃপরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ শব্দদূষণ । আর শব্দদূষণ রোধের জন্য হাইড্রোলিক হর্ন ওউচ্চস্বরে মাইকক বাজানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে ।
সরকারকে এর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করতে হবে । আমাদের যানবাহনের চালক ও মালিকদের হর্ন বাজানোর ব্যাপারে সচেতন হতে হবে । মোটকথা জনসাধারণ সচেতন হলেই শব্দদূষণ রোধ সম্ভব ।
(গ) প্রাকৃতিক সার ব্যবহারঃ আমাদের উচিত প্রাকৃতিক সার ব্যবহার করা । রাসায়নিক সার ব্যবহার করলে আমাদের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে ।
তাছাড়া প্রাকৃতিক সার জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতিসাধন করে না । এজন্য অনেক কৃষিবিদ রাসায়নিক সার ব্যবহার কমিয়ে প্রাকৃতিক সার ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
(ঘ) পরিবেশ আইনের প্রয়োগঃ আমাদের দেশে পরিবেশ রক্ষার জন্য আইনের ব্যবস্থা আছে । পরিবেশ অধিদপ্তর এই আইনের যথাযথ প্রয়োগ করলে পরিবেশ দূষণ কিছুটা রোদ হতে পারে ।
তাছাড়া পরিবেশ দূষণের কারণ ও ফলাফল নিয়ে প্রচারণা চালাতে হবে এবং জনমত গড়ে তুলতে হবে । তাহলে আমরা কিছুটা নিরাপদ হতে পারব বলে মনে করি ।
(ঙ) পানিদূষণ রোধঃ পরিবেশ দূষণের অন্যতম একটি কারণ পানিদূষণ । পানি আমাদের পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান । পানির উপর নির্ভর করে পুরো জীবের অস্তিত্ব ।
এজন্য পানি দূষণরোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর এ জন্য নদীর ধারে কাছে যেসব শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে সেসব শিল্প-কারখানা অন্যএ স্থানান্তর করতে হবে ।
(চ)সচেতনতা বৃদ্ধিঃ পরিবেশদূষণ রোধ করার জন্য আমাদের দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি । এক্ষেত্রে কিছু করতে পারে না, যতক্ষণ না সমগ্র জাতি এটা সম্পর্কে সচেতন না হচ্ছে ।
আমরা যদি দেশে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারি, তাহলে আমরা পরিবেশদূষণ রোধ করতে পারব ।
পরিবেশ রক্ষায় বর্তমান সরকারের পদক্ষেপঃ পরিবেশদূষণ বন্ধে বর্তমান সরকার অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে । সরকার বাসোপযোগী একটি পৃথিবী বা পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছে ।
এর মধ্যে আছে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ, পরিবেশ আদালত স্থাপন, পরিবেশ সংরক্ষণ বিল, টু স্টোক যানবাহন নিষিদ্ধকরণ বনায়ন কর্মসূচি ইত্যাদি ।
উপসংহারঃ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্যই পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে হবে । তা না হলে পরিবেশ দূষণ জনিত অপমৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারবে না। তাই আমাদের আজকের স্লোগান হোক Live and let live অর্থাৎ বাঁচ এবং বাঁচতে দাও ।